আলোচনা - জিহবা ও ভাষার নিয়ন্ত্রণঃ আব্দুদ্দাইয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

October 03, 2021

আলোচনা - জিহবা ও ভাষার নিয়ন্ত্রণঃ আব্দুদ্দাইয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ

https://amarpriyobanglaboi.blogspot.com/

 

আল্লাহ তায়ালা মানবদেহে হাতপাচোখকাননাকজিহবাসহ অনেক মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করেছেন। তিনি আল কুরআনে ইরশাদ করেন,

﴿أَلَمْ نَجْعَل لَّهُ عَيْنَيْنِ﴾ ﴿وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ﴾ ﴿وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ﴾

আমি কি তাকে দুটো চোখএকটি জিহবা ও দুটি ঠোঁট দেই নাইআমি কি তাকে দুটি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি..?” (সূরা বালাদঃ ৮-১০)

আমরা চোখ দিয়ে বস্তু দেখি। কান দিয়ে শুনি। নাক দিয়ে গন্ধ অনুভব করি। পশুর মাঝেও এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। কিন্তু মানুষ আর পশুর মাঝে পার্থক্য হচ্ছে পশুর চোখের সামনে যা পড়ে তা দেখে বা শোনে। কিন্তু মানুষের দেখা ও শোনার মাঝে আল্লাহর পছন্দ বা অপছন্দের সীমারেখার প্রতি খেয়াল রাখা হয়। মানুষ আর পশুর মাঝে পার্থক্য এখানে।

আল্লাহ তায়ালা জিহবার মাঝে পানি দিয়েছেন। আমরা যখন কথা বলি বা খানা-পিনা করি জিহবায় পানি আসে। এর মাধ্যমে খাদ্য সহজে খাদ্যনালীতে যায়। আল্লাহ তায়ালা খাবারের প্রতি লোকমার সাথে পরিমিত পানি সৃষ্টি করে দেন। জিহবা দিয়ে আমরা টক-মিষ্টি-ঝাল আস্বাদন করিকথা বলি। মনের ভাব প্রকাশ করি। কিন্তু শুধু জিহবা থাকলেই মানুষ কথা বলতে পারেনা। এজন্য বাকশক্তি প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কথা বলার জন্য বাকশক্তি দান করেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যারা বোবা কথা বলতে পারেনাকথা বলার নিয়ামত থেকে তারা চিরবঞ্চিত।

আল্লাহ তায়ালা বাকশক্তি দান করার পর মানুষকে নেকি ও গোনাহের দুটি পথ দেখিয়ে ইচ্ছামত বাকশক্তি ব্যবহারের শক্তি দান করেছেন। তাই মানুষ বাকশক্তি প্রয়োগ করে ভালো কথানেকির যেমনি বলতে পারে তেমনি খারাপ কথা- গোনাহের কথাও উচ্চারণ করতে পারে।

খারাপ কথা বলার সাথে সাথে আল্লাহ ইচ্ছা করলে বাকশক্তি রহিত করে দিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননা। তিনি জিহবাকে সিক্ত রেখেছেন সবসময় আল্লাহর যিকির করার জন্য। কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য। দাওয়াতি কাজ করার জন্য। সঠিক কাজে সঠিকভাবে জবান ব্যবহার করা এবং ফাহেশা ও হারাম থেকে যবান হেফাজত করা মুমিন জীবনের বৈশিষ্ট্য।

মিথ্যা কথা বলাগীবত করাঅশ্লীল কথা বলাঝগড়া করা মস্ত বড় গুনাহ। অনেক মানুষ জিহবা ব্যবহার করে এই ধরনের পাপ করছে। তাই আল্লাহ তায়ালা জিহবা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল জিহবা ও ভাষা হেফাজতের বাস্তব শিক্ষা দিয়েছেন।

আল কুরআনে লিসান শব্দের প্রয়োগঃ

আল কুরআনে লিসান শব্দটি কোথাও জিহবা আর কোথাও কোথাও মুখের ভাষা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সূরা মায়েদার ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,

﴿لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ﴾

বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কাফের তাদেরকে দাউদ ও মরিয়ম তনয় ঈসার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে (লিসানে দাউদ ওয়া ঈসা)

সূরা ইবরাহিমের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন,

﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ﴾

আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী (লিসানে কাওমিহ) করেই প্রেরণ করেছি। যাতে তাদেরকে পরিষ্কার করে বুঝাতে পারেন।

সূরা ত্ব-হার ২৭ নম্বর আয়াতে ‘উকদাতান মিন লিসানি’ দ্বারা জিহবা থেকে জড়তা দূর করার প্রার্থনা করা হয়েছেঃ

﴿وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي﴾

সূরা মারইয়ামের ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

﴿فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنذِرَ بِهِ قَوْمًا لُّدًّا﴾

আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছিযাতে আপনি এর দ্বারা পরহেজগারদের সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।

সূরা কাসাসের ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

﴿وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا﴾

আমার ভাই হারুন সে আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী।

অতএব তাকে আমার সাথে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন জানাবে।

সূরা কিয়ামার ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

﴿لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ﴾

তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত অহি আবৃত্তি করবেন না।

জিহবা ও ভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাঃ

প্রকৃত মুসলিম এর যবান নিয়ন্ত্রিত থাকে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেন প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি যার হাত ও যবান থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে- বুখারী।

এই হাদীসে লিসান শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কালাম শব্দ বলা হয়নি। কারণ অনেক মানুষ আছে মূক তারা কথা বলতে পারেনা। কিন্তু মুখের অঙ্গভঙ্গি তথা জিহবা দ্বারাও অপরকে কষ্ট দিতে পারে। মুখের কথা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ভদ্রতা আর অভদ্রতার পার্থক্য ফুটে উঠে।

যাদের ভাষা নিকৃষ্ট তারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারেনা।

এই কারণে রাসূলে কারীম সা. বলেনবান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবেনা যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তর সঠিক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার জিহবা সঠিক না হবে- মুসনাদে আহমদ।

যে ব্যক্তি জবানের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না শয়তান তার দ্বারা অনেক কাজ করায় যা তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তালাক পর্যন্ত হয়ে যায় জিহবা নিয়ন্ত্রণ না রাখার কারণে।

এজন্য রাসূলে কারীম সা. রাগের সময় নীরব থাকতে বলেছেন।

ইবন জাওযী বলেন আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অনেক মানুষ হারাম খাবারযেনা বা চুরি থেকে বিরত থাকতে পারে কিন্তু জিহবার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারেনা।

হযরত সুফিয়ান ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেনআমি আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য সবচেয়ে ভয় করার বস্তু কীতখন রাসূলে কারীম সা. স্বয়ং জিহবাকে বের করে তা হাত দিয়ে ধরে বলেন এটা।

জিহবাকে ভয় করার অর্থ সাবধানতা অবলম্বন করাসচেতনতার সাথে বাক্য প্রয়োগ করাঅনর্থক বাজে কথা না বলা।

আমাদের সব কথা-বার্তা লিপিবদ্ধ করা হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ﴾ ﴿مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴾

স্মরণ রেখো দুই গ্রহণকারী ফিরিশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যা উচ্চারণ করে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে। যে লেখার জন্য সদা প্রস্তুত।’- (সূরা কাফঃ ১৭-১৮)

সুফিয়ান সাওরী একদিন তার সঙ্গীদেরকে বলেন তোমাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকেযে তোমাদের কথা সুলতানের কাছে পৌঁছে দিবেতোমরা কি কোন বলা বলবেসঙ্গীরা বললেন জি না। তিনি তখন বললেন তাহলে জেনে রাখ তোমাদের সাথে এমন লোক আছেন যিনি কথা পৌঁছান অর্থাৎ ফেরেশতাগণ।

জিহবা একদিকে মানুষের বন্ধু অপরদিকে বড় এক শত্রু। জিহবাকে মানব দেহের বডিগার্ড বলা হয়। কোনো বাড়ির গার্ড যদি অসুস্থ হয়ে যায় যেমনি বাড়ির নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। তেমনিভাবে কারো জিহবা অসংযত হওয়ার রোগে আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তি কাকে কি বলে এই নিরাপত্তাহীনতায় সকলে ভোগে। তাই রাসূলে কারীম সা. জিহবা সংযমের নির্দেশনা দান করেছেন।

হযরত উমর বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেন যে ব্যক্তি জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ রাখেন আল্লাহ তায়ালা তার দোষ ঢেকে দেন।

জিহবা নিয়ন্ত্রণের উপকারিতাঃ

আখিরাতে নাজাতের পথ বাক সংযমঃ

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন,

﴿يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم ﴾

সেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহবা হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিবে- (সূরা নূরঃ ২৪)

হযরত উকবা বিন আমের থেকে বর্ণিত তিনি বলেনআমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল আখিরাতে নাজাত পাওয়ার উপায় কীতিনি জবাব দিলেন তোমার কথাবার্তা সংযত রাখতোমার ঘরকে প্রশস্ত কর (অর্থাৎ মেহমানদারি কর) এবং তোমার কৃত আমলের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি কর- তিরমিজি।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠলে সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জিহবাকে অনুনয় বিনয় করে বলে তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তুমি যদি সঠিক পথে থাক আমরাও সঠিক পথে থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে চল তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য- তিরমিজি।

জবানের হিফাজতে জান্নাতের গ্যারান্টিঃ

হযরত সাহল ইবন সাদ থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনযে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্তু অর্থাৎ জিহবা এবং তার দুই ঊরুর মধ্যবর্তী তথা লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব- বুখারী

জিহবা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার শাস্তিঃ

হযরত আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত তিনি বলেনএকবার মুয়ায ইবন জাবাল আল্লাহর রাসূলকে প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যা কিছু বলি তা নিয়ে কি আমাদের পাকড়াও করা হবে। তখন আল্লাহর রাসূল বলেন, ‘হে মুয়ায জবান হেফাজত না করার কারণে মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে’- তিরমিজি।

জবানের হেফাজতে কতিপয় বর্জনীয় কাজঃ

অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথাঃ

সূরা মুমিনুনের ১-৩ আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছেঃ

﴿ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ﴾ ﴿الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ﴾ ﴿وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ﴾

অবশ্যই মুমিনরা সফলকাম হয়েছে যারা নিজেদের সালাতে বিনম্র যারা অনর্থক ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে।

এই আয়াতে উল্লিখিত লাগউন শব্দের অর্থ অনর্থক কথা বা কাজ। আল্লাহর প্রিয়বান্দা হতে চাইলে আমাদেরকে অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

রাসূলে কারীম সা. বলেনব্যক্তি ভালো মুসলিম হওয়ার একটি বৈশিষ্ট্য হলো অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা- তিরমিজি।

হযরত লোকমান হাকীমকে প্রশ্ন করা হলো আপনাকে কোন জিনিস বিজ্ঞ করেছেতিনি জবাব দিলেন ‘আমি অনর্থক কোনো কথা বলি না।

গালি দেয়াঃ

মুমিন কাউকে গালি দেয় না বা অশ্লীল কথা বলে না। রাসূলে কারীম সা. বলেনমুমিন দোষ চর্চাকারী হয় নালানতকারীঅশ্লীল ও গালিগালাজকারী হয় না বাজে কথা বলে না- তিরমিজি।

রাসূলে কারীম সা. বলেনকোনো মুসলিমকে গালি দেয়া ফিসক (গুনাহের কাজ) আর তাকে হত্যা করা কুফর- বুখারী ও মুসলিম।

তিনি আরো বলেনচারটি মন্দ স্বভাব আছে এগুলো যার মধ্যে থাকবে সে খালেস মুনাফিক বলে গণ্য হবে। এই চার স্বভাবের একটি কারো মাঝে থাকলে তার মাঝে মুনাফেকির একটি স্বভাব থাকল। যতক্ষণ না সে তা বর্জন করে। ১. আমানত রাখলে খেয়ানত করে ২. কথা বলে তো মিথ্যা বলে। ৩. প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে ৪. তর্কের সময় গালি গালাজ করে- বুখারী।

মানুষ অনেক সময় রাগের সময় গালিগালাজ করে। তাই রাসূলে কারীম সা. বলেনকেউ যখন রেগে যায় সে যেন চুপ হয়ে যায়- মুসনাদে আহমদ।

রাসূলে সা. আরও বলেনসবচেয়ে বড় কবিরাহ গুনাহ হল ব্যক্তি তার মা- বাবাকে গালি দেয়া। একথা শুনে সাহাবারা বললেন নিজের মা-বাবাকে মানুষ আবার গালি দেয় কিভাবেউত্তরে আল্লাহর রাসূল বললেনব্যক্তি কারো মা-বাবাকে গালি দেয় তখন সে গালিদাতা তার মা-বাবাকে গালি দেয়- বুখারী।
অশ্লীল কথাঃ

হযরত আবু দারদা থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল বলেনকিয়ামতের দিন মুমিনের জন্য মিযানের পাল্লায় সদ্ব্যবহারের চেয়ে অধিক ভারী আর কিছু হবেনা। আল্লাহ তায়ালা অশ্লীল ও কটুভাষীকে অবশ্যই ঘৃণা করেন- তিরমিজি।

রাসূলে কারীম সা. বদর যুদ্ধে যেসব কাফের নিহত হয়েছে তাদেরকে গালি দিতে নিষেধ করেন।

মিথ্যা কথাঃ

মিথ্যা সকল পাপের মূল। মুমিন মিথ্যা বলতে পারে না কারণ মিথ্যা মুনাফিকের স্বভাব। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেশতারা তার থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়- তিরমিজি।

হযরত মুয়াবিয়া ইবন হাইদা থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেন দুর্ভোগ তার জন্য যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলে। দুর্ভোগ তার জন্য দুর্ভোগ তার জন্য- আবু দাউদ।

আল্লাহর রাসূল সা. একবার সাহাবাদেরকে বললেনআমি কি তোমাদেরকে সব চেয়ে বড় কবিরাহ গুনাহ সমূহের কথা বলে দিবসাহাবাগণ বললেন অবশ্যই বলুন আল্লাহর রাসূল। তখন নবী করীম সা. বললেনআল্লাহর সাথে শিরক করা। মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া (এতটুকু বলা পর্যন্ত নবী করিম সা. হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। এরপর নবীজি হেলান দেয়া থেকে বসে বললেন আরো ভালো করে খেয়াল রাখ বড় কবিরাহ গুনাহসমূহের অন্যতম হলো মিথ্যা বলামিথ্যা বলামিথ্যা বলা। নবীজি অতি গুরুত্বের সাথে এই কথা বারবার বলতে লাগলেন। এটা দেখে আমরা মনে মনে ভাবলাম নবীজির তো কষ্ট হচ্ছে। নবীজি যদি একট চুপ করতেন- বুখারী।

আল্লাহর রাসূল আরও বলেন তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই মিথ্যা পাপের পথে নিয়ে যায়। আর পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়।

মিথ্যা সাক্ষ্যঃ

মুমিন কখনও মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে না। আল্লাহ সূরা ফুরকানের ৭২ নম্বর আয়াতে মুমিনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ইরশাদ করেন,

﴿وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا﴾

যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। অসার ক্রিয়া কথার সম্মুখীন হলে ভদ্রতার সাথে পরিহার করে অতিক্রম করে।

আল্লাহর রাসূল বলেনতোমরা শুনে রাখ বড় কবিরাহ গুনাহের অন্যতম হলো মিথ্যা কথামিথ্যা সাক্ষ্যমিথ্যা কথামিথ্যা সাক্ষ্য- বুখারী।

মিথ্যা কসমঃ

সাধারণত কসম করা হয় কাউকে কোন কথা বিশ্বাস করানোর জন্য। নিজের কথার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য। প্রমাণবিহীন কথার প্রমাণস্বরূপ পেশ করার জন্য।

আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কঠোরভাবে মিথ্যা কসমের নিন্দা করে বলেনঃ

﴿إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَٰئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে। পরকালে তাদের কোন অংশ নাই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না। তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি- (সূরা আলে ইমরানঃ ৭৭)

আল্লাহর রাসূল বলেনকেউ যদি মিথ্যা কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের হক কেটে দেয় (মিথ্যা কসমের মাধ্যমে কারো হক নষ্ট করে) আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেন এবং জান্নাত হারাম করে দেন। একথা শুনে এক সাহাবী বললেন যদি সামান্য বস্তুর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। তখন নবী করীম সা. বললেন হ্যাঁ যদি আরাকের (এক প্রকার গাছ) সামান্য একটি ডালও হয়- মুসলিম।

গীবতঃ

জবানের দ্বারা সংঘটিত গুনাহের মাঝে মানুষ অহরহ গীবত করে। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা.কে প্রশ্ন করা হল গীবত কীতিনি উত্তরে বলেন গীবত হলো এই যে তুমি তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সম্বন্ধে এমন কিছু আলোচনা করবে যা সে অপছন্দ করে। আবার প্রশ্ন করা হল তার সম্বন্ধে যা আলোচনা করা হল তা যদি তার মধ্যে বাস্তব থাকে। জবাবে তিনি বললেন হ্যাঁ গীবত তো এটাই। আর যদি বাস্তবে দোষ তার মধ্যে না থাকে ওটাতো অপবাদ- বুখারী।

রাসূলে কারীম সা. আরও বলেনএক মুসলমান অন্য মুসলমানের রক্তসম্পদ ও সম্মানহানি হারাম- মুসলিম।

আমরা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকরই গীবত করি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এই বিষয়ে সতর্ক করে ইরশাদ করেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ﴾

হে মুমিনগণ তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কারণ কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারো গোপন ত্রুটি অনুসন্ধানে পড়বে না এবং তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে। তোমরা তা অপছন্দ করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী অসীম দয়ালু- (সূরা হুজুরাতঃ ১২)

রাসূলে কারীম সা. বলেছেন গীবত যেনার চেয়ে জঘন্য।

আল্লাহর রাসূল বলেনমিরাজের সময় আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের ছিল তামার নখ। সেই নখ দিয়ে তারা নিজেদের চেহারা এবং বুক ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি বললাম জিবরাইল এরা কারা। উত্তরে তিনি বললেন যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত এবং মানুষের সম্মানহানি করত- আবু দাউদ।

পরনিন্দাঃ

সমাজজীবনে ফেতনা-ফাসাদের অনেক ঘটনা চোগল-খুরি বা পরনিন্দার কারণে হয়। পরনিন্দাকারী অন্যকে লাঞ্ছিত করতে গিয়ে নিজে লাঞ্ছিত হয়। আল্লাহ তায়ালা এই ধরনের স্বভাবের নিন্দা করে বলেন,

﴿ وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ﴾

দুর্ভোগ প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির যে পেছনে ও সামনে মানুষের নিন্দা করে” (সূরা হুমাযাহঃ ১)

রাসূল সা. বলেনপরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না- মুসলিম।

দ্বিমুখীপনা/চোগলখুরিঃ

হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেনদ্বিমুখী চরিত্রের লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে- বুখারী।

অন্য এক হাদীসে উল্লেখ আছে যেএকবার রাসূলে কারীম সা. দুটি নতুন কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে গেলেন। দুআ করলেন। খেজুরের ডাল দুই টুকরা করে দুটি কবরে গেড়ে দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম কিছুই বুঝতে পারলেন না। কারণ জিজ্ঞাসা করলে রাসূলে কারীম সা. বললেন কবর দুটিতে এমন কোন গুনাহের কারণে তাদের শাস্তি হচ্ছে না যা থেকে বেঁচে থাকা তাদের জন্য কঠিন ছিল। সহজেই তারা বাঁচতে পারতো। কিন্তু বেঁচে থাকেনি। একজন পেশাবের ফোঁটা থেকে বেঁচে থাকেনি। অপরজন চোগলখুরি করে বেড়াতো। আল্লাহ তায়ালা দুজনকে শাস্তি দিয়েছেন- বুখারী।

দোষ চর্চা করাঃ

একদিন হযরত আয়েশা নিজের কথা বর্ণনা করেন যেআমি একবার নবী করিম সা.-এর কাছে সাফিয়্যা সম্পর্কে বললাম সাফিয়্যা তো এই (অর্থাৎ বেঁটে)। এই কথা শুনে নবীজি বললেন তুমি এমন কথা বলেছো যদি তা সাগরের পানিতে মিশিয়ে দেয়া হয় তাহলে সাগরের পানি ঘোলা হয়ে যাবে- সুনানে আবু দাউদ।

কারো দোষ বর্ণনার পরিবর্তে তা ঢেকে রাখা নেকির কাজ। আবু হুরাইরা বলেনরাসূলুল্লাহ বলেছেনযে বান্দাহ অন্য বান্দার দোষত্রুটি ইহজীবনে গোপন রাখবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন- মুসলিম।

তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও মন্দ নামে ডাকাঃ

হাসি তামাশার স্থলে বা ইচ্ছা করে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা মন্দ নামে ডাকতে দেখা যায়। কিন্তু এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

হে মুমিনগণ কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করোনা এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ। যারা এসব থেকে বিরত না হবে তারা যালেম-(সূরা হুজুরাতঃ ১১)

মাওলানা তাকী উসমানী তাফসীরে তাওযিহুল কুরআনে উল্লেখ করেন যেকাউকে খারাপ নাম দিয়ে দিলে তা তার জন্য পীড়াদায়ক হয়। কাউকে অপমান করা বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা মুমিনের স্বভাব হতে পারেনা।

রাসূলে কারীম সা. বলেনতোমরা পরস্পর ভাই হয়ে যাও। মুসলিম মুসলিমের ভাই। একে অপরের প্রতি যুলুম করোনা এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করোনা- মুসলিম।

বিতর্ক করাঃ

হযরত আবু উমামা বাহেলী থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা. বলেছেনআমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের কিনারায় একটি ঘরের দায়িত্ব গ্রহণ করব যে সত্য ও সঠিক হবার পরও বিতর্ক ছেড়ে দেয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে কোন গৃহের জামিন হব যে ঠাট্টাস্থলেও মিথ্যা পরিহার করে। আর যে ব্যক্তির চরিত্র সুন্দর হবে তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি ঘরের দায়িত্ব গ্রহণ করব- আবু দাউদ।

হাসি তামাশা ও ঠাট্টা করাঃ

কাউকে নিয়ে হাসি তামাশা করা শোভনীয় নয়। হযরত আবু হুরায়রা বলেনসাহাবায়ে কেরাম রাসূলে কারীম সা.কে একবার বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও আমাদের সাথে হাসি তামাশা করেন। তখন নবীজি বলেন হ্যাঁ আমি হাসি তামাশা করি তবে আমি সত্য ছাড়া বলিনা- তিরমিজি।

এই হাদীস থেকে বুঝা যায় সত্য কথা শরিয়তের সীমার মাঝে আনন্দদায়কভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তবে এটা মাঝে মধ্যে করা যায়। সব সময় হাসি তামাশায় মত্ত থাকা ঠিক নয়।

শোনা কথা বলে বেড়ানোঃ

হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলে কারীম সা.কে বলতে শুনেছেন যেকোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে তা বলে বেড়ায়- মুসলিম।

ভালো-মন্দ বিচার না করে কথা বলাঃ

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত তিনি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছেন কোন বান্দা ভালো মন্দ বিচার না করে এমন কথা বলে যার কারণে সে পদস্খলিত হয়ে জাহান্নামের এতদূর গভীরে চলে যায় যা পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দূরত্বের সমান- বুখারী।

কথায় কষ্ট দেয়াঃ

হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সা. এর সামনে একজন নারী সম্পর্কে বলা হল সে খুব নফল নামায পড়ে রোযা রাখে এবং দান সদকা করে। কিন্তু তার মুখের ভাষা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ বললেন সে জাহান্নামি। ঐ ব্যক্তি আরেকজন নারী সম্পর্কে বললেন যার নফল রোযা ও দান সদকার ক্ষেত্রে কোন প্রসিদ্ধি নাই। কখন হয়ত সামান্য পনিরের টুকরা সদকা করে তবে সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কেউ তার মুখের ভাষায় কষ্ট পায় না। রাসূলুল্লাহ বললেন সে জান্নাতি- মুসনাদে আহমদ।

অভিশাপ ও বদদোয়াঃ

হযরত সামুরা ইবনে জুন্দব থেকে বর্ণিত তিনি বলেনআল্লাহর রাসূল বলেছেন তোমরা একে অপরকে আল্লাহর অভিসম্পাততাঁর গজব ও জাহান্নামের বদদোয়া করো না- মুসনাদে আহমদ।

গোপন কথা ফাঁস করাপ্রতিশ্রতি ভঙ্গ করাঃ

কারো গোপন কথা ফাঁস করা বড় ধরনের অপরাধ। অর্থ-সম্পদ যেমনিভাবে আমানত অনুরূপভাবে গোপন কথা বার্তাও আমানত। আমরা অনেক সময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যে গোপন কথা ফাঁস করব না কিন্তু কারো সাথে ঝগড়া হলে অথবা মুখ ফসকে অহরহ গোপন কথা ফাঁস করতে দেখা যায়। আবার বলা হয় এটা অত্যন্ত গোপন। শুধু আপনাকেই বলছি। আপনি আর কাউকে বলবেন না।

অহেতুক তোষামোদী করাঃ

একজন মানুষ আরেকজনকে কৃতজ্ঞতা জানানো ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু তোষামোদী করে প্রশংসা করবে না। আল্লাহ তায়ালা তখন অসন্তুষ্ট হন যখন কোন ফাসেকের প্রশংসা করা হয়। তবে কারো গুণাবলি তুলে ধরা তোষামোদী নয়। যেমন রাসূলে কারীম সা. আবু বকরউমরউসমানআলীমায়ায ইবন জাবালসহ অনেক সাহাবার গুণাবলি তুলে ধরে প্রশংসা করেছেন।

তাকাল্লুফি করাঃ

অনেক সময় দেখা যায় কারো ক্ষুধা আছে। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার কি ক্ষুধা আছেআপনি কিছু খাবেনতখন পেটে ক্ষুধা রেখেও বলা হয় না ক্ষুধা নেই। এই ধরনের তাকাল্লুফি ঠিক নয়। আসল অবস্থা বর্ণনা করা উচিত।

জবানের হেফাজতে কতিপয় করণীয়

বাকসংযম করা ও কথা বলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করাঃ

হযরত বেলাল বিন হারেস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনরাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনমানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এমন কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ কিয়ামত পর্যন্ত তার দরুন তার সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। আবার মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না। অথচ তার দরুন কিয়ামত পর্যন্ত তার অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন- মুয়াত্তা মালেক।

মিষ্টভাষী হওয়াঃ

হযরত আলী রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেন যে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, নিশ্চয়ই জান্নাতে বালাখানা থাকবে যার ভিতরের সব কিছু বাহির থেকে দেখা যাবে। একজন বেদুঈন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল ঐ বালাখানা কাদের জন্য হবেআল্লাহর রাসূল জবাবে বললেন, যারা মিষ্টভাষী হবেঅভাবীদের আহার দেবে ও রাতের গভীরে নামায পড়বে- তিরমিজি।

আমাদের সকলের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলতে হবে। স্বামী-স্ত্রীভাই-বোনছেলে-মেয়েআত্মীয়স্বজনপ্রতিবেশীপরিচিত অপরিচিতনেতা-কর্মীশাসক-শাসিত সকলেই পরস্পরের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলে আমরা সদকার সাওয়াব অর্জন করতে পারি।

আবু হুরাইরা রা. বলেননবী করিম সা. বলেছেনমানুষের প্রত্যেক সংযোগস্থলের উপর প্রত্যেক দিন সদকা ওয়াজিব হয়। তবে দুজনের মধ্যে ইনসাফ করা দরকার। কোনো ব্যক্তিকে তার সওয়ারির উপর উঠিয়ে দেয়া কিংবা তার মালপত্র তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করা সদকা। ভালো কথা বলা সদকা। নামাযের জন্য যত কদম চলবে প্রত্যেক কদমে সদকা। আর রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়াও সদকা- বুখারি।

সর্বদা সত্য কথা বলাঃ

আল্লাহর রাসূল বলেনসদা সত্য বল। কেননা সত্য ভালো কাজের পথে পরিচালিত করে। আর ভালো কাজ জান্নাতে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার চেষ্টায় থাকে একপর্যায়ে আল্লাহর খাতায় সিদ্দিক (চির সত্যবাদী) নামে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়- মুসলিম।

জিহবাকে আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত রাখাঃ

এক সাহাবা রাসূল সা.-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন ইসলামের বিধানতো অনেক। আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা আমি গুরুত্বের সাথে পালন করব। আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমার জবান যেন সদা আল্লাহর যিকির দ্বারা সতেজ থাকে- তিরমিজি।

ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকাঃ

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেনযে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে- বুখারি ও মুসলিম।

চুপ থাকাতে অনেক ফজিলত রয়েছে। চুপ থাকলে মেজাজ সংযত থাকেঅন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি থাকেযিকির ও ইবাদতের জন্য সময় মিলে। আর বেশি কথা বলার মাঝে নানা রকম বিপদ রয়েছে: কথা বেশি বলার কারণে ভুল বেশি হয়।

মিথ্যাগিবতচোগলখুরিপরনিন্দারিয়াকপটতানির্লজ্জতাকথা-কাটাকাটিবাড়িয়ে কথা বলাঅপরকে কষ্ট দেয়াঅন্যের গোপন কথা ফাঁস করে দেয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুটো কান আর একটি মুখ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে আমরা বেশি শুনতে হবে। আর বলতে হবে কম।

অনেক মানুষ সব সময় বেশি কথা বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু প্রয়োজনের আলোকে কথা বলা দোষণীয় নয়। আমাদেরকে তিন অবস্থার যে কোনো এক অবস্থায় জিহবাকে রাখতে হবে: ১. সৎ কাজের আদেশ বা অসৎ কাজের নিষেধ ২. আল্লাহর যিকির ৩. চুপ থাকা।

কথা বলার ক্ষেত্রে নম্রতা বজায় রাখাঃ

জিহবা একটি নরম গোস্তের টুকরা। কথা বলার সময় নম্রভাবে বলা উচিত। হযরত আয়েশা রা. বলেনএকবার একদল ইয়াহুদি আল্লাহর রাসূলের কাছে এসে বলল ‘আসসামু আলাইকুম’ অর্থাৎ তোমার মরণ হোক। আয়েশা রা. বললেনতোমাদের উপর আল্লাহর লানত ও গজব পড়ুক তখন নবী করিম সা. বললেন হে আয়েশা একটু থাম। নম্রতা অবলম্বন করা তোমাদের কর্তব্য। রুঢ়তা ও অশালীনতা বর্জন কর। আয়েশা বললেন তারা যা বলেছে আপনি কি তা শোনেননি। তিনি বললেন আমি যা বললাম তুমি কি তা শোননি। কথাটি তাদের উপরই ফিরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং তাদের ব্যাপারে আমার কথা কবুল হবে। আর আমার সম্পর্কে তাদের কথা কবুল হবে না- বুখারি।

সান্তনার বাণী শোনানোঃ

আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে নানা সমস্যায় জর্জরিত। যেমন বর্তমানে কোভিড-১৯ এই বৈশ্বিক মহামারী চলছে। অনেক মানুষ অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা দরকার। শুধু হতাশা নয় মানুষের মাঝে সান্তনার বাণী ছড়িয়ে দেয়া নেকির কাজ।

রাসূল সা. বলেছেন যদি কোনো ব্যক্তি এমন নারীকে সান্তনার বাক্য বলে যার ছেলে নিখোঁজ হয়ে গেছে বা মারা গেছে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা ঐ সান্তনাদানকারীকে জান্নাতে মূল্যবান জামাজোড়া পরিধান করাবেন।

কোনো ব্যক্তি পথ চিনছে না আমরা যদি তাকে পথ দেখাতে সাহায্য করি এটাও নেকির কাজ।

কোন ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের মাঝে থাকলে তাকে সান্তনা দিলে বা তার পেরেশানি দূর করার জন্য পরামর্শ দিলে সাওয়াব মিলে।

জিহবা দ্বারা দ্বীনি শিক্ষা দেয়াঃ

জবান দ্বারা কাউকে যদি দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হয় তাহলে অনেক নেকি অর্জন হবে। যেমন কেউ কুরআন পড়তে পারে না। তাকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেউ ভুলভাবে নামায পড়ে। তাকে নামাযের সঠিক নিয়ম শিক্ষা দেয়া। জিহবার সামান্য নড়াচড়ায় যদি কারো নামায সহিহ হয়ে যায় এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে?

আল্লাহ অসন্তুষ্ট এমন কথা না বলাঃ

হযরত আবু হুরাইরা বলেন রাসূল সা. বলেছেনযদি তোমার কোনো বিপদ আসে তাহলে এরূপ বলোনাঃ যদি আমি এরূপ করতাম তাহলে এরূপ হতো। বরং তুমি বল আল্লাহই তাকদিরে লিখেছেন। আর তিনি যা চান তা করেন। কারণ যদি শব্দটি শয়তানের কাজ চালু করে দেয়া- মুসলিম।

বৈরী পরিবেশেও ইনসাফের কথা বলাঃ

আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেনআল্লাহর রাসূল সা. বলেছেনস্বৈরাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলা উত্তম জিহাদ- তিরমিজি।

অধীনস্থ বা চাকরের সাথে ব্যবহারঃ

আনাস রা. বলেনকোনো পশমি ও রেশমি কাপড়কেও আমি রাসূল সা. এর হাতের তালুর চেয়ে অধিকতর নরম ও মোলায়েম মনে করি না। কোন সুগন্ধিকেও আমি রাসূল সা.-এর শরীরের সুগন্ধির চেয়ে অধিকতর সুগন্ধি পাইনি। আমি দীর্ঘ দশ বছর তাঁর খেদমতে ছিলাম। কিন্তু কখনও তিনি আমার প্রতি উহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। আমার কৃত কোনো কাজের জন্য বলেননি যেকেন তুমি এটা করলেআর কোনো কাজ না করার জন্য বলেননি কেন তুমি করলে না?- বুখারি।

সুসংবাদ ও মুবারকবাদ দেয়া মুস্তাহাবঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

﴿وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَن يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ﴾ ﴿الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾

অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদের যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা ভালো তা গ্রহণ করে- (সূরা যুমারঃ ১৭-১৮)

কেউ কোন ভালো কাজ করলে তার জন্য তাকে মুবারকবাদ দেয়া বা কাউকে কোনো সুসংবাদ পৌঁছানো মুস্তাহাব।

অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে দুআ করাঃ

হযরত আয়েশা রা. বলেননবী করিম সা. নিজের পরিবারের কোনো রোগীকে দেখতে গেলে তার উপর ডান হাত বুলিয়ে বলতেন, হে আল্লাহ মানুষের প্রভু। রোগ দূরকারী রোগমুক্তি দান কর। তুমিই রোগমুক্তি দানকারী। তোমার রোগমুক্তি ছাড়া কোনো রোগমুক্তি কার্যকর নয় যা কোনো রোগকে ছাড়ে- বুখারি।

সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস বলেনযখন আমি অসুস্থ ছিলাম তখন আল্লাহর রাসূল আমাকে দেখতে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ সাদকে রোগ মুক্তি দান কর। হে আল্লাহ সাদকে রোগমুক্তি দান কর। হে আল্লাহ সাদকে রোগমুক্তি দান কর- মুসলিম।

কথা বলা প্রসঙ্গে আল কুরআনে বর্ণিত কতিপয় পরিভাষাঃ

সঠিক কথা বলা-কাওলান সাদিদাঃ

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সঠিক কথা বলতে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا﴾ ﴿يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا﴾

হে মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রমসমূহ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে তারা অবশ্যই মহাসফলতা লাভ করবে। (সূরা আহযাবঃ ৭০-৭১)

শিষ্টাচারপুর্ণ কথা বলা-কাওলান কারিমাঃ

আল্লাহ বলেন,

﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا﴾

তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যেতাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করোনা এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদের উহ শব্দটিও বলোনা এবং তাদেরকে ধমক দিওনা। তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। (সূরা বনি ইসরাঈলঃ ২৩)

সহজভাবে কথা বলা-কাওলান মায়সুরাঃ

আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِّن رَّبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُل لَّهُمْ قَوْلًا مَّيْسُورًا﴾

তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ থাকাকালে যদি কোন সময় তাদেরকে বিমুখ করতে হয় তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল। (সূরা বনি ইসরাঈলঃ ২৮)

নম্রভাবে কথা বলা-কাওলান লায়্যিনাঃ

আল্লাহ বলেন,

﴿اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ﴾ ﴿فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ﴾

তোমরা উভয়েই ফেরাউনের কাছে যাও সে উদ্ধত হয়েছে। অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল। হয়ত সে চিন্তা ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে। (সূরা ত্বাহাঃ ৪৩-৪৪)

শরিয়তসম্মত কথা বলা-কাওলান মারুফাঃ

﴿وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُم بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنتُمْ فِي أَنفُسِكُمْ ۚ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَٰكِن لَّا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّا أَن تَقُولُوا قَوْلًا مَّعْرُوفًا ۚ وَلَا تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ﴾

আর যদি তোমরা আকার ইঙ্গিতে সেই নারীর বিবাহের পয়গাম দাও কিংবা নিজেদের মনে গোপন রাখ তবে তাতেও তোমাদের কোনো দোষ নাই আল্লাহ জানেন যে তোমরা অবশ্যই সেই নারীদের কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু তাদের সাথে বিয়ে করার গোপন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখো না। অবশ্য শরিয়ত নির্ধারিত প্রথা অনুযায়ী কোনো কথা সাব্যস্ত করে নিবে। (সূরা বাকারাঃ ২৩৫)

﴿وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا وَارْزُقُوهُمْ فِيهَا وَاكْسُوهُمْ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَّعْرُوفًا﴾

আর যে সম্পদ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জীবন যাত্রার অবলম্বন করেছেন তা অর্বাচীনদের হাতে তুলে দিওনা। বরং তা থেকে তাদেরকে খাওয়াও পরাও এবং তাদেরকে সান্তনার বাণী শোনাও। (সূরা নিসাঃ ৫)

অন্যত্র বলেন,

﴿وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُولُو الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُم مِّنْهُ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَّعْرُوفًا﴾

এবং সম্পত্তি বণ্টনের সময় আত্মীয় স্বজনইয়াতিম ও মিসকিন উপস্থিত হয় তখন তা থেকে তাদের কিছুই খাইয়ে দাও এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ কর। (সূরা নিসাঃ ৮)

উপদেশপূর্ণ কল্যাণকর কথা বলা-কাওলান বালিগাঃ

﴿أُولَٰئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا﴾

এরা হল সেই সমস্ত লোক যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা অবগত। অতএব আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। (সূরা নিসাঃ ৬৩)

গুরুতর কথা-কাওলান আযিমাঃ

﴿أَفَأَصْفَاكُمْ رَبُّكُم بِالْبَنِينَ وَاتَّخَذَ مِنَ الْمَلَائِكَةِ إِنَاثًا ۚ إِنَّكُمْ لَتَقُولُونَ قَوْلًا عَظِيمًا﴾

তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান নির্ধারিত করেছেন এবং নিজের জন্য ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা গুরুতর গর্হিত কথা বলছ। (সূরা বনি ইসরাঈলঃ ৪০)

গুরুত্বপূর্ণ বাণী-কাওলান সাকিলাঃ

﴿إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا﴾

আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। (সূরা মুযযাম্মিলঃ ৫)

এই আয়াতে ভারী কালাম বলে কুরআন বুঝানো হয়েছে। কেননা কুরআন বর্ণিত হালাল হারামজায়েয-নাজায়েয এর সীমা স্থায়ীভাবে মেনে চলা স্বাভাবিকভাবে ভারী ও কঠিন। তবে যার জন্য আল্লাহ তায়ালা সহজ করে দেন তার কথা স্বতন্ত্র।

কুরআনকে ভারী বলার আরেক কারণ এই যেকুরআন নাযিল হওয়ার সময় রাসূল সা. বিশেষ ওজন অনুভব করতেন ফলে প্রচণ্ড শীতেও তাঁর মস্তক ঘর্মাক্ত হয়ে যেতো। তিনি তখন কোনো উটের উপর সওয়ার থাকলে বোঝার কারণে উট নুয়ে পড়ত। বুখারি।

কুরআনে কথা বলার কতিপয় নির্দেশনাঃ

কথাবার্তায় কর্কশ হবেন নাঃ

﴿فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ﴾

( হে নবী!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যেতোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল৷ নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতেতাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো ৷ তাদের ক্রটি ক্ষমা করে দাও৷ তাদের জন্য মাগফিরাতে দোয়া করো এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তরভুক্ত করো৷ তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমরা স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো৷ আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)

লোকদের সাথে ধীরস্থিরভাবে শান্তভাবে কথা বলুনঃ

﴿فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ﴾

তার সাথে কোমলভাবে কথা বলোহয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে (সূরা ত্বা-হাঃ ৪৪)

উচ্চস্বরে কথা বলবেন নাঃ

﴿وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ﴾

নিজের চলনে ভারসাম্য আনো  এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো৷ সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ (সূরা লুকমানঃ ১৯)

অন্যকে উপহাস করবেন নাঃ

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

হে ঈমানদারগণপুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে৷ হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম৷ আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে৷ হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম৷ তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না৷ এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না৷ ঈমান গ্রহণের পর গোনাহর কাজে প্রসিদ্ধ লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার৷ যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম। (সূরা আল হুজুরাতঃ ১১)

পিতা-মাতার প্রতি সম্মানজনক কথা বলুনঃ

﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا﴾

তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেনঃ তোমরা কারোর ইবাদাত করো নাএকমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো৷ পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো৷ যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকেতাহলে তাদেরকে “উহ্‌” পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩)

সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করবেন নাঃ

﴿وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

মিথ্যার রঙে রাঙিয়ে সত্যকে সন্দেহযুক্ত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করার চেষ্টা করো না (সূরা আল বাকারাঃ ৪২)

কাউকে খোঁটা দিয়ে কথা বলবেন নাঃ

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُم بِالْمَنِّ وَالْأَذَىٰ كَالَّذِي يُنفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا ۖ لَّا يَقْدِرُونَ عَلَىٰ شَيْءٍ مِّمَّا كَسَبُوا ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾

হে ঈমানদারগণ!তোমরা অনুগ্রহের কথা বলে বেড়িয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাতকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করে দিয়ো না যে নিছক লোক দেখাবার জন্য নিজের ধন-সম্পদ ব্যয় করেঅথচ সে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে না এবং পরকালেও বিশ্বাস করে না ৷ তার ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ একটি মসৃণ পাথরখন্ডের ওপর মাটির আস্তর জমেছিল৷ প্রবল বর্ষণের ফলে সমস্ত মাটি ধুয়ে গেলো ৷ এখন সেখানে রয়ে গেলো শুধু পরিষ্কার পাথর খন্ডটি ৷এই ধরনের লোকেরা দানখয়রাত করে যে নেকী অর্জন করে বলে মনে করে তার কিছুই তাদের হাতে আসে না ৷ আর কাফেরদের সোজা পথ দেখানো আল্লাহর নিয়ম নয় ৷ (সূরা আল বাকারাঃ ২৬৪)

কাউকে গালাগাল করবেন নাঃ

﴿وَإِذِ اسْتَسْقَىٰ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِب بِّعَصَاكَ الْحَجَرَ ۖ فَانفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا ۖ قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ ۖ كُلُوا وَاشْرَبُوا مِن رِّزْقِ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ﴾

স্মরণ করো , যখন মূসা তার জাতির জন্য পানির দোয়া করলো , তখন আমরা বললাম , অমুক পাথরের ওপর তোমার লাঠিটি মারো ৷ এর ফলে সেখান থেকে বারোটি ঝর্ণাধারা উৎসারিত হলো ৷  প্রত্যেক গোত্র তার পানি গ্রহণের স্থান জেনে নিল ৷ ( সে সময় এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, ) আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক খাও , পান করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। (সূরা আল বাকারাঃ ৬০)

বিভক্তি উসকে দিবেন নাঃ

﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾

তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না৷ আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো৷ তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র ৷ তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন৷ ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো৷ তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে৷ আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন ৷ এভাবেই আল্লাহ তাঁর নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন ৷ হয়তো এই নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩)

প্রতারণার পক্ষে ওকালতি করবেন নাঃ

﴿إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ ۚ وَلَا تَكُن لِّلْخَائِنِينَ خَصِيمًا﴾

হে নবী ! আমি সত্য সহকারে এই কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছিযাতে আল্লাহ তোমাকে যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সেই অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে ফায়সালা করতে পারো৷ তুমি খেয়ানতকারী ও বিশ্বাস ভংগকারীদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। (সূরা আন নিসাঃ ১০৫)

অন্য ধর্মের দেব-দেবীর প্রতি অবমাননা করবেন নাঃ

﴿وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ كَذَٰلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِم مَّرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

আর ( হে ঈমানদারগণ!) এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিয়ো না৷ কেননাএরা শিরক থেকে আরো খানিকটা অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত যেন আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে৷ আমি তো এভাবে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের কার্যক্রমকে সুশোভন করে দিয়েছি৷ তারপর তাদের ফিরে আসতে হবে তাদের রবের দিকে৷ তখন তিনি তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে জানিয়ে দেবেন। (সূরা আল আনআমঃ ১০৮)

মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করুন হিকমা ও উত্তম ভাবেঃ

﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ﴾

হে নবী! প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সদুপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে৷ তোমার রবই বেশী ভালো জানেন কে তাঁর পথচ্যুত হয়ে আছে এবং সে আছে সঠিক পথে। (সূরা আন নাহলঃ ১২৫)

জিহবা সংরক্ষণে কতিপয় পরামর্শঃ

যখন কোনো কথা বলার প্রয়োজন হবে তখন চিন্তা করতে হবেঃ

-   এই কথাতে দ্বীনের কোনো উপকার ও কল্যাণ আশা করা যায় কিনা?

-   এই কথাতে তার জাগতিক কোনো ফায়দা আছে কিনা?

কথা বলার আগে ভাবা তারপর বলা। কারণঃ

-   না ভেবে কথা বলার কারণে অনেক সময় লজ্জিত হতে হয়।

-   অনেক সময় পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়।

আমরা জীবনের অনেক বছর পার করেছিঃ

-   অতীতে হয়ত জবানের হেফাজত সঠিকভাবে করতে পারি নাই।

-   আজ থেকে জবানের হেফাজত করব এই ধরনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মিথ্যা প্রপাগান্ডা না ছড়ানোঃ

-   বিশেষভাবে ফেসবুকে বা পত্রিকায় কিছু দেখেই অনেকে যাছাই বাছাই না করা তা অন্যকে বলা শুরু করে দেন।

আমরা যা বলি তা আমল লেখক সম্মানিত ফেরেশতাগণ রেকর্ড করেন। (সূরা ইনফিতারঃ ১০-১১)

﴿وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ﴾ ﴿كِرَامًا كَاتِبِينَ﴾

-   হযরত হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেন ফেরেশতাগণ মানুষের প্রতিটি বাক্য রেকর্ড করেন।

-   আর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন কেবল সেই সব বাক্য লিখিত হয় যেগুলো সাওয়াব বা শাস্তিযোগ্য।

তরবারির আঘাতে কারো শরীরে ক্ষত হলে তা শুকিয়ে যায়। কিন্তু জিহবার আঘাতের ক্ষত সহজে শুকায়না। কারণঃ

-   তরবারির আঘাত লাগে দেহে আর জিহবার আঘাত লাগে কলিজায়।

-   তাই এমনভাবে কোনো কথা বলা উচিত নয় যা কারো হৃদয়ে আঘাত করে।

-   কবি বলেনবর্শার যখম শুকিয়ে যায় কিন্তু জবানের যখম শুকায়না।

অতএব আমাদেরকে ভাবা দরকার আমি আমার মুখের ভাষা দ্বারা কাউকে কষ্ট দিয়েছি কিনা। যদি তা করে থাকি তার কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন।

আর অনুমাননির্ভর কোনো কথা না বলে তথ্য যাচাই বাছাই করে কথা বলা বা তথ্য দেয়া দরকার।

-   এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন

যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নাই সে বিষয়ে অনুমান করে কথা বলো না। কেননা কর্ণ চক্ষু হৃদয় ওদের প্রত্যেকের বিষয় কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা বনি ইসরাঈলঃ ৩৬)

﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا﴾

জবানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল গুনাহ থেকে আমাদের সকলকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে।

-   কারো নাম ব্যঙ্গ করাবিদ্রু করাঅশ্লীল কথা বলাগালি দেয়াপরনিন্দা করামিথ্যা অপবাদ দেয়াচোগলখুরি করাবিনাপ্রয়োজনে গোপনীয়তা ফাঁস করামুনাফেকি করাহারাম বা নাজায়েজ জিনিস নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পাওয়াগিবত করাখারাপ উপনামে ডাকাঅভিশাপ দেওয়াঅযথা চিৎকার করে চেঁচামেচি করাবেহুদা কথা বলামিথ্যা কথা বলাঅশ্লীল গান গাওয়াকারো মুখোমখি প্রশংসা করাআল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কথা না বলাকেউ মারা গেলে উচ্চ স্বরে বিলাপ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।

জবান বা জিহবা যেসব কারণে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়না তা চিহ্নিত করতে হবে। যেমনঃ

-   আমরা অধিক রাগের কারণে অনেক সময় মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারিনা।

-   আবু হুরাইরা বলেন রাসূল সা. বলেছেন কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয় লাভ করাতে বীরত্ব নেই বরং ক্রোধ ও রাগের মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের লক্ষণ।

-   জনৈক সাহাবা রাসূল সা. কে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাকে অসিয়ত করুন। আল্লাহর রাসূল বলেন লাতাগযাব-তুমি রাগ করোনা। এই কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেন।

-   রাগ নিয়ন্ত্রণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। (সূরা আলে ইমরানঃ ১৩৪)

﴿الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾

যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষক্রটি মাফ করে দেয়৷ এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন

-   রাসূল সা. বলেন যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অথচ সে তা বহিঃপ্রকাশ করতে সক্ষম। তাকে আল্লাহ তায়ালা যে কোন হুর নির্বাচন করার ইখতিয়ার দিবেন।

কারো অপরাধ ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ। কারো দুঃখ কষ্ট বা অন্যায় ক্ষমা করে দিলে তার সাথে খারাপ কথা বলার প্রশ্নই উঠে না।

-   একজন মুমিন আরেকজন মুমিনকে হৃদয় থেকে ক্ষমা করে দেয়। (সূরা আলে ইমরানঃ ১৩৪)

﴿الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾

যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষক্রটি মাফ করে দেয়৷ এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।

-   হযরত উকবা ইবন আমের বলেনরাসূল সা. বলেছেন হে উকবা আমি কি তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতবাসীর সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য বলব। (আর তা হলো) যে তোমার সাথে সম্পর্কছেদ করবে তুমি সম্পর্ক গড়বেযে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তুমি তাকে দান করবেআর যে তোমার প্রতি যুলুম করেছে তুমি তাকে ক্ষমা করবে।

-   আল্লাহ তায়ালা অন্যকে তার ভুলের জন্য ক্ষমা করতে বলেছেন।

﴿خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ﴾

হে নবী! কোমলতা ও ক্ষমার পথ অবলম্বন করো৷ সৎকাজের উপদেশ দিতে থাকো এবং মূর্খদের সাথে বিতর্কে জড়িও না। (সূরা আল আরাফঃ ১৯৯)

-   আবু হুরাইরা বলেনরাসূল সা. এর কাছে জনৈক ব্যক্তি বলল ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমার কিছু আত্মীয়স্বজন আছে আমি তাদের সাথে আত্মীয়তা রক্ষা করি কিন্তু তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি কিন্তু তারা আমার সাথে খারাপ আচরণ করে। আমি তাদের বেলায় সহ্য করি কিন্তু তারা আমার সাথে কুআচরণ করে। তখন তিনি বললেন যদি তুমি তোমার কথায় সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে তুমি যেন তাদের মুখে গরম ছাই প্রবেশ করাচ্ছ। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা তোমার সাহায্যে রত থাকবে যতক্ষণ তুমি সে অবস্থার উপর থাকবে- মুসলিম।

প্রতিনিয়ত মুহাসাবা করা। আত্মপর্যালোচনা ও আত্মপর্যবেক্ষণ করা।

-   আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকনা কেন আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন?’ (সূরা হাদীদঃ ৪)

﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ ۚ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا ۖ وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾

তিনিই আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আরশে সমাসীন হয়েছেন৷ যা কিছু মাটির মধ্যে প্রবেশ করেযা কিছু তা থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কিছু আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু আসমানে উঠে যায় তা তিনি জানেন৷  

-   আল্লাহ তায়ালা চোখের ঘাতকতা ও মনের গোপন কথা জানেন। (সূরা গাফেরঃ ১৯)

﴿يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ﴾

-   আমাদের সকল কথা রেকর্ড হচ্ছে। অতএব আমাদেরকে প্রতিনিয়ত আত্মপর্যালোচনা করা প্রয়োজন আমরা আমাদের মুখের ভাষা ও জিহবা দিয়ে কাউকে কষ্ট দিয়েছি কিনাকারো প্রতি কটু কথা বলেছি কিনাশরিয়তের সীমালংঘন হয়েছে কিনা?

-   মূলত এইভাবে মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা শুধু পানাহার ও যৌনসংগম থেকে বিরত থাকা সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকার নাম নয়। বরং দেহের রোযার সাথে সাথে চোখপেট ও জিহবার সিয়াম সাধনা যথাযথ করলেই প্রকৃত রোযা পালন হবে।

-   মাগফিরাতরহমত ও নাজাতের মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোযা রেখেই আমাদেরকে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করতে হয় আর দোজখের দরজা বন্ধ রাখতে হয়।

-   প্রতি বছর মাহে রমযানের এই ট্রেনিং সারা বছর জাগরূক রাখতে পারলেই আমাদের দুনিয়ার জীবন শান্তিময় হবে আর আখিরাতে মিলবে নাজাত।

জিহবা বা ভাষা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজস্ব কোনো পন্থা অবলম্বন করা।

-   হযরত আবু বকর একদিন স্বীয় জিহবা ধরে বসেছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন আপনি এমনটি করছেন কেনতিনি জবাব দেন যে এই জবান আমাকে ধ্বংসের দিকে নিপতিত করছে এজন্য আমি এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছি।

-   আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন তাঁর কসম যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। জিহবা ব্যতীত ভূপৃষ্ঠে আর কোনো বস্তু নাই যাকে দীর্ঘসময় কারারুদ্ধ করে রাখা প্রয়োজন।

-   ইবনে উমর বলেন মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে সংশোধনের অঙ্গ হলো তার জিহবা।

-   ইমাম শাফেয়ী বলেন হে রাবী অনর্থক কথা বলোনা। কেননা তোমার বলে ফেলা কথার জন্য একদিন তোমাকে পাকড়াও করা হবে।

-   উমর ইবন আব্দুল আজিজ বলেন হৃদয় হলো রহস্যের সিন্ধুক ওষ্ঠাধর হল তার তালাআর জিহবা হলো তার চাবি। 

 

লেখকঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম (লেখাটি ছাত্রসংবাদ থেকে কপি করে সম্পাদনা করা হয়েছে। মূল লেখায় কুরআনের রেফারেন্স সমূহে আরবী ব্যবহার করা হয়নি)

লেখাটি A4 সাইজে পিডিএফ ডাউনলোড করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

 


No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।